এপ্রিল,২০১৪,
শেষ কবে ঘুরতে গেছি ভুলে গেছিলাম। কাজের চাপ রোজকার ব্যাস্ততা আর ঘুরতে গেলেই খরচ হয়ে যাবে অনেক টাকা, এই করতে করতে কয়েক বছর কেটে গেছে। তারপর এক বন্ধু বলল ওরা ৯ জন মিলে বার্সে- হিলে ট্রেক করতে যাবে, আমি যাব কিনা। সেদিন ভাবলাম অনেক হয়েছে আর না, এবার যাবই। এর আগে আমার পাহাড় যাওয়া বলতে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, তখন আমার বয়স ৭/৮ বছর আর টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম । এছাড়া আর কোন পাহাড়ের স্মৃতি আমার নেই।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমার সরঞ্জাম বলতে ছিল একটি ৩৫ লিটারের রুকস্যাক। অমিত আমাকে কি কি নিতে হবে তার একটা ফর্দ করে দিয়েছিল। আমি ব্যাগে জামা- কাপড় আর দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। শিয়ালদহ পৌঁছে দেখি আরও অনেকে এসেছে । আমরা মোট ১০ জন সদস্য ছিলাম। আমি, অমিত, স্বপ্নেন্দু, পৃথা, সৌরভ, আস্পাক, অমিতাভ দা, অরিন্দম দা, দেবাঞ্জলি দি আর আমাদের দেড় বছরের ছোট্ট ডোডো। আপনি ঠিকই পড়ছেন আমরা ২০১৪ তে যখন এই ট্রেকে যাই তখন ডোডোর বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর।
প্রথমে হিলে থেকে বার্সে যাওয়া হবে। তারপর যেদিকে ইচ্ছে যাওয়া হবে, যেখানে ইচ্ছে থাকা হবে। সঙ্গে টেন্ট আছে, ব্যাগে রান্না করার মত প্রয়োজনীয় রসদ আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌছাতে হবে হবে কারণ ফেরার টিকিট কাটা আছে।
আমরা শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেস ধরে পরের দিন নিউ জলপাইগুড়ি পৌছালাম ৮.৩০ নাগাদ। ওখানে আমাদের গাড়ি আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সেবক রোডে আস্তেই চোখ জুরিয়ে গেল। তিস্তার নীল জল, পাহাড়ি রাস্তা, চারিদিকে সবুজ পাহাড় এই সব তো শুধু সিনেমা আর ইউটিউব ভিডিও তেই দেখেছি। প্রথমবার এইসব দেখার অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল।
আমরা জোরথাঙ্গে দাঁড়ালাম দুপুরের খাবারের জন্য। হিলে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে প্রায় ৪.৩০। সময় লাগল প্রায় ৮.৩০ ঘন্টা। অরিন্দম দা আর দেবাঞ্জলি দি ডোডোকে নিয়ে হোটেলে ছিল আর আমরা বাকিরা হোটেলের সামনেই টেন্টে ছিলাম। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। টেন্টের জন্য আমাদের দিতে হয়েছিল ১০০ টাকা করে।
প্রথম দিন- হিলে থেকে বার্সেঃ
পরের দিন সকালে টেন্ট থেকে সূর্যদয় দেখার অভিজ্ঞতা যারা টেন্টে থেকেছেন তারাই বুঝতে পারবেন। আমরা প্রাতরাশ সেরে ৯.০০ নাগাদ ট্রেক শুরু করলাম। এন্ট্রি ফি ছিল ৩০/- টাকা প্রতি জন, আর ক্যামেরার জন্য ৫০/- টাকা।
ট্রেক শুরু করার আগে অমিত বলে দিয়েছিল কোথাও যেন কোন প্লাস্টিক বা ক্যান্ডির র্যাপার না ফেলি। এই অভ্যেস টা আমার এখনও রয়ে গেছে, আমি তারপর থেকে রাস্তার ডাস্টবিন বা ঘরের ডাস্টবিন ছাড়া কোথাও কোনো কিছু ফেলিনা।
আমাদের বার্সে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল প্রায় ৪ ঘন্টা। এই সম্য সাধারনত চারিদিকে রডোডেন্ড্রনে ভরে থাকে, এই কারণে এই ট্রেককে বার্সে রডোডেন্ড্রনে ট্রেকও বলা হয়। কিন্তু আমাদের ভাগ্য অত ভাল ছিলনা কারণ এই বছর সেইভাবে ফোটেনি।
অরিন্দম দা আর দেবাঞ্জলি দি ডোডোকে নিয়ে ছিল গুরাস কুঞ্জে, আর আমরা টেন্টে । এখানেও টেন্টের জন্য লাগল ১০০ টাকা প্রতি টেন্ট।
ওখানে টেন্ট লাগানোর পর অরিন্দম দা রান্না করছিল আর আমরা সাহায্য করছিলাম। হঠাৎ শুরু হল তুষার পাত। তারপর একটা বড় তির্পল কে কোথা থেকে নিয়ে এসেছিল মনে নেই, আমরা সবাই সেই তির্পল তা ধরেছিলাম আর অরিন্দম দা নিচে রান্না করছিল। যখন তুষার পাত থামল তখন চারিদিক সাদা হয়ে গেছে। এই ধরণের অভিজ্ঞতা গুলোই একটা ট্রিপ কে স্মরণীয় করে রাখে।
দ্বিতীয় দিন – বার্সে থেকে বারিয়াখোপ
পরের দিন সকালে উঠতেই ভোরের সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজংঘা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রাতরাশ সেরে আমরা এক অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। যেতে যেতে যেখানে ভাল লাগবে সেখানেই থাকা হবে এটাই পরের ৩/৪ দিনের পরিকল্পনা।
প্রায় ৫/৬ ঘন্টা হাঁটার পর বারিয়াখোপ নামে এক গ্রামে পৌছালাম। আমরা ডোডোর জন্য একটা ঘরে থাকতে দেবার অনুরোধ করেছিলাম, আর ওনারা সবথেকে ভাল ঘরটি আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তৃতীয় দিন- বারিয়াখোপ
আজকের একটা ঘটনা বলি, আমাদের সকাল বেলার রান্নার প্রস্তুতি চলছে, বাড়ির মালকিনকে দেখলাম বাঁশের খুঁটিতে দড়ি বাঁধতে। খুঁটি টা একটু লম্বা হওয়ায় ওনার বাঁধতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, তাই আমাদের একজন সাহায্য করতে গেছিলেন। পরে বুঝলাম উনি দড়িটা বাঁধছিলেন দেবাঞ্জলি দিকে ডোডোর কাপড় কাচতে দেখে, যাতে কাপড় শুকোতে দিতে পারি। এই ধরনের আতিথেয়তার কথা আমরা শহুরে লোকেরা হয়তো ভাবতেও পারিনা।
এই ট্রিপে ঠিক হয়েছিল যারা যে কাজে পটু নয় তাদের সেই কাজটি করতে হবে। আর আমার ঘারে চাপলো রান্না করা। মেসে থাকার সময় বন্ধুদের রান্না করায় সাহায্য করার অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু একা রান্না করার অভিজ্ঞতা মাত্র ২ বার তাও মেসের ৫/৬ জনের জন্য। রাধুনি হিসাবে আমার লেভেলটা অনেকটা এইরকম যে আমি রান্না করে দেব আমার রিস্কে, কিন্তু খাওয়ার রিস্কটা আপনার। আর এই কাজে আমার সহকারি ছিল সৌরভ। সেও রান্নায় আমার মতই পটু। ভয় ভয় রান্না করা শুরু করলাম। মেনু ছিল ভাত ডাল আর সোয়াবিনের তরকারি। কাজটা যাই হোক করে উতরে দিয়েছি।
বারিয়াখোপ থেকে দোদকের পথে
চতুর্থ দিন – বারিয়াখোপ থেকে দোদক
আজ প্রাতরাশ সেরে আমরা সকাল ৯টা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। প্রায় ৪ ঘন্টা হাঁটার পর দোদক নামে একটা গ্রামে পৌছালাম। আজকে আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো, সেটা হলো ঝর্ণায় স্নান। অনেকেরই হয়তো এই অভিজ্ঞতা আছে , কিন্তু প্রথমবার ঝর্ণায় স্নানের ব্যাপারটাই আলাদা। বাকি দিনটা আশেপাশে ঘুরে আর ছবি তুলেই কেটে গেল।
পঞ্চম দিন – দোদক থেকে সিংলিং
আজ সকাল ৯.৩০ নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। হাটতে হাটতে একটা যায়গায় দেখি রাস্তায় পড়ে অনেক সাদা কাঠি। নিজের স্টক প্রায় শেষ তাই, দেখে একেবারে আল্লাদে আটখানা। ক্লান্ত শরীরে যেন নতুন করে এনার্জি ফিরে পেলাম। রাস্তায় পড়ে থাকা স্যাতসাতে সিগারেট গুলো সব পকেটস্থ করে আবার হাটা শুরু হল। কিছুক্ষণ পর আমরা পৌছালাম আমাদের এই ট্রিপের শেষ গ্রাম সিংলিং। গিয়ে প্রথম কাজ কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেট গুলো রোদে দেওয়া। যার বাড়ির সামনে আমরা ক্যাম্প করলাম তিনি বেশ অমায়িক মানুষ, নাম দুষন রাও। তার নামের সাথে তার ব্যক্তিত্বের কোনো মিল নেই। বাড়ির চারিদিকে সুগন্ধি গাছ, আর বেশ কিছু ঔষধি গাছ লাগানো আছে আর তার মাঝে আমদের টেন্ট। ভাবলেই মনটা ভাল হয়ে যায়।
ঘরে ফেরার পালা
পরের দিন দূষণ রাও আমাদের জোরথাং পর্যন্ত ছেড়ে দিলেন। সেখান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে গাড়ি বুক করে পৌছালাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। তারপর পদাতিক এক্সপ্রেস ধরে বাড়ি।
বার্সে রডোডেনড্রন ট্রেক আমার প্রথম ট্রেক। এই ট্রিপে আমি অনেক কিছু শিখেছি, অনেক কিছু করেছি যা এর আগে কোনোদিন করিনি, আমি একটি তাঁবুতে থেকেছি, ঝর্নার জলে স্নান করেছি, ৯ জনের জন্য রান্না করেছি, প্রথমবার তুষারপাত দেখেছি, আর দেখেছি একটি দেড় বছরের বাচ্চা তার বাবা মায়ের সাথে ৭ দিনের ট্রেক শেষ করেছে, দেখেছি পাহাড়ি গ্রামে মানুষের সরল জীবন যাপন।
আমি কোনো লেখক নই তাই আমার অনুভুতি গুলো ভাষায় প্রকাশ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এইটুকু বুঝেছি এই ট্রিপ আমার জীবন যাপনকে অনেকটা পালটে দিয়েছে ।